
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১৫ প্রকৌশলী। দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এসব প্রকৌশলী রয়েছেন গ্রেপ্তার আতঙ্কে। আবার দুর্নীতির দায়েও কেউ কেউ বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকৌশলী কাজে নিয়মিত নন। ফলে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে অধিদপ্তরজুড়ে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। তাতেও কাজে গতি আসেনি। তবে গণপূর্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ষড়যন্ত্র করে কিছু ঠিকাদার এসব প্রকৌশলীকে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি করেছেন। পতিত সরকারের সুবিধাভোগী হলেও এসব প্রকৌশলী সরাসরি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতা করেননি। তারা বলছেন, দ্রুত এসব মামলার বিষয়ে সুরাহা না করলে গণপূর্তের কাজে গতি আসবে না। যার প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে।
মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে ১৬ জন প্রকৌশলীকে। এর মধ্যে একজন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। বাকিরা গণপূর্তের। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য ছিলেন।
রাজধানীর পল্টন থানায় হত্যা মামলা ছাড়াও রামপুরা, সাভার থানায় মামলা করা হয়েছে। কয়েকজন প্রকৌশলী একাধিক থানায় হত্যা মামলায় আসামি হয়েছেন। প্রধান প্রকৌশলী ছাড়াও আসামির তালিকায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের তিন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও একজন আছেন গণপূর্ত থেকে প্রেষণে যাওয়া জাতীয় গৃহায়নের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী।
জানা যায়, মামলার তালিকায় থাকা প্রকৌশলীরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অনিয়ম-দুর্নীতির সামনের সারিতে ছিলেন। ছাত্র আন্দোলন দমনে অর্থদাতা হিসেবে মামলার আসামি করা হয়েছে তাদের। তারাই এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন।
মামলার আসামিরা ছাড়াও পতিত সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা দলবাজি করেছেন, তারাও অফিসে অনিয়মিত। অনেকের অফিস কেবল হাজিরার মধ্যে সীমাবদ্ধ। মামলার আসামির তালিকায় প্রকৌশলীদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, অনেকেই বারবার পুরস্কৃত হয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা আছে এবং তদন্ত চলছে। অনিয়ম-দুর্নীতিসহ ছাত্র-জনতা হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে আসামিদের অনেকেই এখন নানা তদবির-লবিং করছেন।
মামলার বিষয়ে কর্মরত কয়েকজন প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে কালবেলা। তারা বলেছেন, এ মামলা দাঁড় করানোর সঙ্গে জড়িত কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। মূল উদ্দেশ্য, মামলার আসামিদের বিভিন্ন চাপে রেখে ঠিকাদারি কাজ ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা এখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ মামলায় গ্রেপ্তারের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। টাকা দিলেই মামলা থেকে রেহাই পাব, এমনও কেউ কেউ বলছেন।
তারা আরও বলেন, এটা সত্য যে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডসহ দলীয়করণ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যারা বিগত সরকারের সময় সুযোগ-সুবিধা ভোগ ও দুর্নীতি-অনিয়ম করেছেন, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। তা না করে ঢালাওভাবে মামলা দেওয়া হয়েছে। এ মামলার গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন আসামিরা। প্রকৌশলীদের অভিযোগ, মামলা নিয়ে সুনির্দিষ্টাভাবে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সুরাহ করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করা হয় রামপুরা থানায়। এরপর সাভার ও পল্টন থানায়। কোনো কোনো প্রকৌশলীকে একাধিক থানায় হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আক্তার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) মো. শামছুদ্দোহা, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (গণপূর্ত ভবন) মো. শহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আলমগীর হোসেন, জাতীয় গৃহায়নের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহাম্মাদ, গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুব রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহম্মেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মনিরুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতী নাথ বসাক, মুহাম্মাদ জাকির হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ, নির্বাহী প্রকৌশলী সমিরন মিস্ত্রি, জাতীয় গৃহায়ন ইএম ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিরাজ, নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুজ্জামান চুন্নুর নামে রামপুরা থানায় মামলা করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী আমানউল্লাহ আমানও মামলার আসামি।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) মো. শামছুদ্দোহা মিরপুর, আজিমপুর ও নারায়ণগঞ্জে আবাসিক ভবন নির্মাণের দায়িত্বে আছেন। সাভার ও সার্কেল-৪ দেখভাল করেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (গণপূর্ত ভবন) মো. শহিদুল ইসলাম। প্রধান প্রকৌশলীর সব কাজ করে থাকেন তিনি। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আলমগীর হোসেন ঢাকা ১, ২ ও ৩ সংসদ ভবন, সচিবালয়, ঢাকা মেডিকেল, হাইকোর্ট ভবন নির্মাণসহ সারা দেশে ইলেকট্রনিক ও মেকানিক্যাল কাজের দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহাম্মাদ বর্তমানে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতী নাথ বসাক সচিবালয় ২০ তলা ভবন, মুগদা হাসপাতাল ভবন নির্মাণ, মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে ভবন নির্মাণের দায়িত্ব পালন করছেন। আলোচিত জিকে শামীমসহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সখ্যর বিভিন্ন অনিয়মের কারণে তাকে এসব প্রকল্প কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি রিজার্ভে আছেন।
প্রকৌশলী আসামিদের মধ্যে বড় বড় প্রকল্পের দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় সবাই। এখনো কেউ কেউ দায়িত্বে রয়েছেন। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহম্মেদকে বিভিন্ন অনিয়ম করার কারণে ঢাকা থেকে সিলেট বদলি করা হয়েছে। সিলেট ও হবিগঞ্জে দুটি ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর আগে তিনি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। টানা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন একই কর্মস্থলে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যখন যিনিই মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার সঙ্গেই দহরম মহরম সম্পর্ক গড়ে তুলতেন ইলিয়াস।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মনিরুল ইসলাম (সার্কেল-১) নিউরো সায়েন্স, ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণকাজের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা অফিসার্স ক্লাব প্রকল্প, পুলিশ লাইন, মন্ত্রীপাড়া, বঙ্গভবন উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব পালন করছেন।
সাভারে জিন ব্যাংক নির্মাণ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বেতার, নারায়ণগঞ্জ উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব। বর্তমানে তিনি আইসিবি ভবন নির্মাণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, বিচারপতির বাসভবন উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের দায়িত্বে আছেন।
ছাত্র-জনতা হত্যায় মামলার বিষয়ে তিন দিন কথা বলতে গেলে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাউকে পাওয়া যায়নি। মামলার বিষয়ে শুনে তারা রুম থেকে বের হয়ে যান এবং বলেন মিটিং আছে। এখন এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। এমনকি একাধিকবার মোবাইলে ফোন দিলে তারা কেউ ধরেননি। তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আলমগীর হোসেনের সঙ্গে দেখা হলেও এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না বলে গাড়িতে করে চলে যান।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া ও বিভিন্ন হলের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে। ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় তো দূরের কথা, তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও কাজ শেষ করা যায়নি। এবার চতুর্থবারের মতো সময় বৃদ্ধি করে ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। তবে এখনো শেষ হয়নি।
স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ফায়ারিং বেজে আধুনিকায়ন, ঢাকা আজিমপুর সরকারি কলোনির অভ্যন্তরীণ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ, সচিবালয় ২০ তলা প্রসাশনিক ভবন ও মসজিদ নির্মাণ, শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরি, মিরপুর পাইকপাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কমচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম শহরে সরকারি পরিত্যক্ত বাড়িতে আবাসিক ফ্ল্যাট ও ডরমিটরি ভবন নির্মাণ, অফিসার্স ক্লাবের সুইমিংপুলসহ বহুতল ভবন নির্মাণ, গোপালগঞ্জ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ, ময়মনসিংহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামাজিক কেন্দ্র পার্ক নির্মাণ, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বৈদ্যুতিক যান্ত্রিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন, চট্টগ্রাম জেলায় পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন সবুজ উদ্যান উন্নয়ন, সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে সুপ্রিম কোর্টে এক্সটেনশন ভবন, আগারগাঁও শেরেবাংলা নগর কিছু প্রকল্প, নারায়ণগঞ্জ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৮টি ১৫ তলা ভবন নির্মাণ, বঙ্গভবনের ৩ নম্বর গেটে অফিসারদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ এবং হলি পার্কের কাছে গেস্ট হাউস নির্মাণ ও আধুনিকায়ন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে এগুলো এখনো চলমান। কিন্তু কাজের অগ্রগতির জন্য চাপ দিলেও অর্থ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। যার কারণে এসব উন্নয়নকাজ চলছে ধীরগতিতে। অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বর মাসে সরকার অর্থ ছাড় দিলে কাজের অগ্রগতি বাড়বে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘এটা মামলা নয়, অভিযোগ দাঁড় করা হয়েছে। যারাই এটা করেছেন, হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এ নিয়ে কর্মকর্তারা আতঙ্কিত নন। কাজেরও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।’
গণপূর্ত অধিদপ্তরের চলমান বড় বড় প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। সব প্রকল্প চলমান আছে। নিয়মিত অর্থ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কাজের কোনো স্থবিরতা নেই।’
এসব বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হামিদুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, ‘অভিযোগ হয়েছে। মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হলে পরবর্তী সময়ে এটা আমরা দেখব। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
আপনার মতামত লিখুন :